• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৩:ডিসেম্বর || ১৮:৩১:৪২
প্রকাশের সময় :
এপ্রিল ১৪, ২০২২,
১:১২ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
এপ্রিল ১৪, ২০২২,
১:১২ অপরাহ্ন

২৮ বার দেখা হয়েছে ।

এক বাতিঘর

এক বাতিঘর

পুষ্পিতা সরকার।। 

ইট-কংক্রিটের মতো জমে যাওয়া শক্ত খোলসে চাপা পড়া ক্ষমতা, ভোগ দখলের পৈশাচিক দম্ভ আর মেকি আনন্দ কুড়িয়ে ফুটো থলে ভর্তি করার মতো আজকের এই নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের চেয়ে কিছুকাল পূর্বেও একসময়ের জীবনযাত্রা সহজ ছিল। সেকালে রবি ঠাকুরের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা আর নজরুলের প্রিয় বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতো লালন ফকির, হাসন রাজা, আব্বাস উদ্দীনের মর্মস্পর্শী সুরের ব্যঞ্জনা। তবে সেসময় আজকের তুলনায় কুসংস্কারের তীব্রতা বেশি ছিল। তৎকালীন সময়ে পুরুষেরা নারী সেজে নারী চরিত্র যে কী সুন্দর ফুটাতে পারতো তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যাবে না! তবে এখনো গ্রাম বাংলায় উন্নত মন-মানসিকতা ও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শহরের বেশিরভাগ মানুষই সচেতন ও কুসংস্কারমুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশ তো গ্রাম-প্রধান দেশ। অজপাড়াগাঁ’কে কে শোনাবে সভ্য সংস্কৃতির অঙ্গিকার? কে আহ্বান জানাবে সভ্য সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত হতে? আজ এমনই একজন কান্ডারির জীবনযাত্রার ওপর আলোকপাত করবো।

নির্জনে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এই বাতিঘর অপরিচিত, অবহেলিত, দরিদ্র এক গ্রামের বঞ্চিত এক মানব সন্তান। আমার পরম সৌভাগ্য তাঁকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করতে পেরেছি। তিনি একাধারে একজন দক্ষ সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সমাজসেবক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। এক কথায় সভ্য সমাজের সকল বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন ঘটেছে এই মানুষটির কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে। মানিকগঞ্জ জেলার অন্তর্গত শিবালয় থানায় আরুয়া ইউনিয়নের নালী গ্রামে ১৯৬৯ সালের ৯ জানুয়ারী মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব “রণজিৎ কুমার সরকার”। পিতা নীলকমল সরকার ও মাতা সন্ধ্যা রাণী সরকারের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম সন্তান। শিক্ষাজীবন শুরু করেন তাঁর বড় মামা শ্রী সুধীর মজুমদারের কাছে। এরপর স্থানীয় নালী বড়রিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে নালী বড়রিয়া কৃষ্ণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বশেষ এম.কম. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি বি.এড. ডিগ্রিও অর্জন করেন। কিশোরবেলা থেকেই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটতে আরম্ভ করে। খুব স্বল্প সময়ে তিনি এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন বিভিন্ন সামাজিক  কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। তখনকার সময় এলাকার যতগুলো নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল সবগুলোতেই তাঁর উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করবার মতো। তাঁর নিজের লেখা কবিতা, গল্প, সেই সব অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে এলাকার মানুষের নিকট তিনি খ্যাতি লাভ করেন। সেই সাথে গ্রামের সকল শ্রেণীর লোকের কাছে প্রিয়পাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর বুদ্ধির প্রখরতা ছিল চমৎকার। সমাজে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের সাথে তাঁর যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে। তাদের বিপদে আপদে তিনি ছিলেন একমাত্র ভরসা এবং প্রতিবাদের একমাত্র মাধ্যম।

তিনি খুব অল্প বয়সে রাজনৈতিক জীবনে পা রাখেন। যখন থেকে রাজনীতি শুরু করেন তখন হয়তো রাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাও তাঁর হয়নি। একজন রাজনীতিবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো। তিনি অকাতরে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। তাঁর জীবনে ছিল না কোনো আড়ম্বর, কোনো চাকচিক্য। অথচ তিনি নিজেই ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যার আলোয় আলোকিত আজ হাজারো মানুষ। আমি তাঁর কর্মতৎপরতায় সদা সততা, পরোপকারীতা দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “রাজনীতিতে কেন আসলেন?” তিনি বলেছিলেন, “আমি রাজনীতি বুঝি না। শুধু জানি বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর আদর্শকে বুকে রেখে দলকে ভালোবেসে কাজ করে যাচ্ছি। আর কিছু না। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।” কী অপূর্ব তাঁর মন্তব্য!

ছাত্রজীবনে ১৯৮৫ সাল থেকে নিজেকে সংবাদপত্রের সাথে সম্পৃক্ত করেন। প্রথমে তিনি মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পতাকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। এরপর সংবাদ প্রতিক্ষণ, লাল-সবুজ, আল-আযান পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি ভোরের ডাক পত্রিকার জেলা সংবাদদাতা ও সাপ্তাহিক আবাবিলের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবেও কাজ করেছেন। সর্বশেষ ভোরের কাগজ পত্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করেন। তাঁর এই মহান পেশায় আসার জন্য তাঁকে যে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন তিনি হলেন মানিকগঞ্জ জেলার বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তাক আহমেদ। উল্লেখ্য পত্রিকাগুলো ছাড়াও তিনি তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনে বহু পত্রিকায় কাজ করেছেন। তিনি “মুক্তাঙ্গন” নামক একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদকও ছিলেন। চাহিদা অনুযায়ী সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তিনি সমাজে তথা দেশের বেকার সমস্যা লাঘবের জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন তিনি। আর এই জন্যেই অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের হাত থেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছিলেন “আদর্শ লোকগীতি শিল্প গোষ্ঠী”। এই সংস্থার মাধ্যমে গ্রামের অপরিচিত এবং অবহেলিত শিল্পীদেরকে একত্রিত করে তাদের মানসিক শান্তি দেয়ার প্রয়াসে কাজ করেছেন প্রতিনিয়ত। এছাড়া তিনি এলাকার যুব সমাজকে সাথে নিয়ে বিনোদন এবং আনন্দমূলক অনুষ্ঠান যেমন- নাটক, বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান, এলাকায় বিভিন্ন সময় নিরক্ষরতা দূর করার জন্য গণশিক্ষা কার্যক্রমসহ প্রভৃতি কার্যক্রম অত্র অঞ্চলের “রক্তরাগ খেলাঘর আসর”-এর মাধ্যমে সম্পন্ন  করতেন।

ধর্মীয় চেতনাতেও তিনি ছিলেন প্রখর। তাই বহুকাল শিবালয় উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুদের কোমল মনকে সুস্থভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজ বাসগৃহে বলা চলে একাই শুধু মানুষের কল্যাণ করার সুতীব্র ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে ১৯৯৪ সনের ২৭শে এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেন শিবালয় উপজেলার সর্বপ্রথম শিশু শিক্ষা নিলয়। যার নাম ‘আদর্শ শিশু বিদ্যা নিকেতন, নালী। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি সগৌরবে হাজারো সুসন্তান গড়ার কাজ অব্যাহত রেখেছে।  ২০০০ সালের ৩ অক্টোবর তারিখে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী সংগীতা সরকার ও একমাত্র সন্তান পুষ্পিতা সরকারের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

তিনি ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন সময়ে গ্রামে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার প্রাথমিক ব্যবস্থা কিংবা ঔষুধ-পত্রের সংকুলান ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। এমতাবস্থায় তিনি একটি ফার্মেসী প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ‘সরকার ফার্মেসী’। যেখানে স্বল্পমূল্যে কখনো বা বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ করতেন গ্রামের অসহায় মানুষদের জন্য। এরপর তিনি দীর্ঘদিন স্থানীয় হাই স্কুল “নালী বড়রিয়া কৃষ্ণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়” এ সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ প্রধানশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ‘মোকসেদ আলী একাডেমী’তে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে তিনি ব্রেইন স্ট্রোক করেন। সেসময় তাঁর চোখের রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়। এতে করে তিনি আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকেন। এমনকি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলারও ভয় ছিল। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন। গ্রামের অসহায় মানুষের প্রার্থনা আর ভালোবাসায় তিনি সেবার আরোগ্য লাভ করেন। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছিল তিনি যেন কোনো চাপ না নেন। কিন্তু তিনি যে কান্ডারি তাঁর কি ঘরে বসে থাকলে চলবে! তিনি তাঁর মহৎ কর্মযজ্ঞ ঠিকই অব্যাহত রাখেন। উল্লেখ্য যে, তিনি জীবনের শেষাংশে আরুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, শিবালয় উপজেলা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি এবং মানিকগঞ্জ জেলা সাংবাদিক সমিতির সিনিয়র সদস্য ছিলেন। এক কথায় তাঁর জীবনপরিক্রমা ছিল স্নিগ্ধ, সুন্দর, পরার্থে উৎসর্গীকৃত কর্মব্যস্ত।

তিনি সারাজীবন শুধু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন বিনিময়ে নিজেকে নিঃস্ব করেছেন। খেয়ে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, আরাম-আয়েশ ভুলে শুধু মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করেছেন। নিজের প্রতি এমন অনাদর, অবিচার তাঁর মন মেনে নিলেও শরীর কিন্তু মেনে নেয়নি। তাই মাত্র ৫১ বছর বয়সে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবরে তাঁর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেন।

মৃত্যুতেই কি সব শেষ? তিনি যে কল্যাণধারা বর্ষণ করে গেছেন তা আজও প্রবাহমান। হয়তো বা বড় বড় সমাজ সেবকদের মতো ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম এবং কর্মকাণ্ড স্থান পাবে না। তবে তাঁর এলাকার মানুষের মনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম। এমন মানুষের জন্ম যুগ-যুগ ধরে সাধনা করলেও হয় না। এঁরা আসে সুন্দরের গায়ে জমা অসুন্দরের কালো মেঘের ছায়া দূর করে নিজেকে জ্বালিয়ে বাতিঘর হতে। এঁরা অবিনশ্বর, এঁরা অমর।

 

  • লেখিকা- রণজিৎ কুমার সরকারের এক মাত্র  সন্তান।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *