
লে. কর্নেল মোঃ রুহুল আমীন (অব.)
তৃতীয় মাসে গড়াল রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান যা শুরুতে আশা করা হয়েছিল যে মাস খানেকের মধ্যেই ইউক্রেন দখলে চলে যাবে রাশিয়ার। লক্ষ্য ছিল প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অপসারণ করে রুশবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠা করা, রাশিয়া কর্তৃক পূর্বে দখলকৃত ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেন থেকে সদ্য বিচ্ছিন্ন দোনেত্স্ক ও লুহানস্ক-এর স্বীকৃতি আদায় করা এবং ইউক্রেনের ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তি রোধ করা। এরপর রাশিয়ার অভিযান বন্ধ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। রাজধানী কিয়েভে পৌঁছার পরও বিজয় লাভ সম্ভব হয়নি। জেলেনস্কিকে অপসারণ এবং সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সম্বরণ করার রুশ আহ্বান কার্যকর হয়নি। জেলেনস্কির দৃঢ় নেতৃত্বে সেনাবাহিনী এবং জনগণ প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দেশত্যাগ করেননি এবং যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কিছু দেশ ইউক্রেনকে অস্ত্র-গোলা এবং ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহ করে ঝড়ের গতিতে এবং উদারভাবে। বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি রাশিয়ার প্রচণ্ড হামলায় রাজধানী কিয়েভসহ প্রায় সমগ্র ইউক্রেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়নি। আত্মরক্ষার যুদ্ধে ইউক্রেন যেমন সৈন্য ও অস্ত্র-রশদ হারিয়েছে, ৫০ লাখের বেশি (এক-চতুর্থাংশ) মানুষ দেশ ত্যাগ করেছে এবং নিহত হয়েছে, তেমনি রাশিয়াও প্রচুর সৈন্য হারিয়েছে। পশ্চিমা ক্রমাগত অবরোধে রাশিয়া কিছুটা হলেও কাবু হয়েছে। বলা যায় রাশিয়া গ্যাঁড়াকলেই আটকা পড়েছে। তবে রাশিয়া এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছাড়বার পাত্র নন। তিনি বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়াকে শিক্ষা দেয়ার পণ করেছে আর রাশিয়া তার জবাব দেয়া শুরু করেছে। পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় আপাতত ইউক্রেন যুদ্ধের খবর প্রথম পৃষ্ঠায় বা উত্সাহের সাথে প্রকাশিত হচ্ছে না। কিন্তু দু’পক্ষের হুমকি-ধমকি থামছে না যা অশনি সংকেতের নামান্তর। ইতোমধ্যে পোল্যান্ড ও জার্মানি সৈন্য সমাবেশের হুমকি দিয়েছে; জার্মানি ও পোল্যান্ডসহ ইইউ দেশগুলোতে রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ স্থগিত করছে, রাশিয়া যুদ্ধে চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বনের আভাস দিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে আনুমিত হচ্ছে বিশ্ব কি তৃতীয় মহাযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে ? তার মানে পারমাণবিক যুদ্ধ এবং বিশ্বের ধ্বংস। আমরা তা চাই না; বিধাতা আমাদের রক্ষা করুন।
ইউক্রেনকে বশে আনতে না পেরে রাশিয়া বিকল্প পথ অনুসরণ করছে। ইউক্রেন কর্তৃক গেরিলা ও আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা এবং জনগণের আবাস ধ্বংস হয়েছে, হতাহত হয়েছে অনেক। সম্মুখ সমরে রাশিয়া সৈন্য হারতে চায় না। তাই আকাশ যুদ্ধ এবং ক্ষেপণাস্ত্র ও মিসাইলের আঘাত জারি রেখেছে এবং নতুন ফ্রন্টের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। এখন দক্ষিণ ও পূর্বের দনবাস অঞ্চল নিজ দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলই এখন প্রধান রণক্ষেত্র। এতে করে বিকল্প লক্ষ্য অর্জনের পথে রাশিয়া। তাতে সম্পূর্ণ ইউক্রেন দখল করতে না পারলেও ইউক্রেনের অর্ধেকেরও বেশি রাশিয়ার দখলে চলে যাবে। সেজন্যই দক্ষিণে ক্রিমিয়ার মূল সংযোগের জন্য খেরসন, ওদেসা বন্দর, মিকোলাইভ এবং মেলিটোপোল কবজায় নিচ্ছে। আর পূর্বে লুহানস্ক ও দোনেত্স্কর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মেলিটোপোল, মারিওপোল, জাপোরিঝিয়া ও খারকিভ দখল করা গেলে পুরো দনবাস অঞ্চল দখলে আসবে এবং লুহানস্ক ও দোনেতেস্কর স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে দক্ষিণপ্রান্তের ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়ার সাথে অবাধ স্থল যোগাযোগ স্থাপিত হবে যা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে রুশ বাহিনী বন্দর নগরী মারিওপোল দখলে এনে দুর্গসম বিশাল ইসপাত কারখানায় আশ্রয় নেয়া কয়েক হাজার ইউক্রেন সেনা ও বেসামরিক ব্যক্তিকে অবরোধ করে রেখেছে। এছাড়া, কৃষ্ণ সাগরে ও আজভ সাগরের তীরে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও নৌঘাঁটি অকার্যকর হবে এবং ক্রিমিয়া সমগ্র সাগর এলাকার প্রভুত্ব বিস্তার করবে। ওদিকে মলদোভার বিছিন্ন এলাকা ইজমাইল নিয়ন্ত্রণে আসবে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ইউক্রেন পশ্চিমাদের অবাধ সহায়তায় ধরে রাখতে পারলেও দুর্বলতম অবস্থানে চলে আসবে। তাই এই যুদ্ধে সামরিকভাবে রাশিয়াই লাভবান হবে বেশি এবং ভবিষ্যতে কূটনৈতিক আলোচনা এবং শান্তি চুক্তি হতে হলে রাশিয়া বড় দরকষাকষি করতে সক্ষম হবে। রাশিয়া নিশ্চিত করতে চাইবে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে এবং লুহানস্ক ও দোন্তেস্কের স্বাধীনতার স্বীকৃতি। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না এই নিশ্চিয়তাও দিতে হবে। ইউক্রেনের দাবি একটাই অগ্রগণ্য হবে অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা। সেই প্রসংগ এনে রাশিয়া ইহুদি বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ও তার ইহুদি প্রধান সরকারের পরিবর্তন চাইবে।
রাশিয়ার অভিযান প্রলম্বিত হওয়ার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের কূটনীতি, উস্কানি ও ব্যাপক সামরিক সহায়তা। তারা চেয়েছে রাশিয়া যুদ্ধে আটকা পড়ে ক্রমাগত দুর্বল ও ক্লান্ত হোক এবং অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত অবরোধে কাহিল হয়ে পড়ুক। ওদিকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও অন্যান্য সাহায্য এবং খবর রয়েছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ভাড়াটে সেনা প্রেরণ করে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে তারা। এইসব সামরিক সাহায্যের মধ্যে রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, জ্যাভেলিন ও স্ট্রিংগারের মতো ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র,সাঁঝোয়া বহর, যুদ্ধ বিমান, মিসাইল। সর্বশেষ যুক্টরাষ্ট্র ইউক্রেনকে “সুইচবোর্ড” নামের ড্রোন সরবরাহ করছে যা অত্যাধুনিক এবং রুশ সেনা ও সাঁজোয়া বহরের ওপর সফল আক্রমণ করবে। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডসহ কয়েকটি ন্যাটো দেশ ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর চিন্তা করছে। গত ২৭ এপ্রিল জার্মানির মার্কিন বিমান ঘাঁটি রামস্টেইনে যুক্তরাষ্ট্র ৪০টি পশ্চিমা মিত্র দেশকে নিয়ে আলোচনায় বসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের আরো পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রাশিয়া তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থে আঘাত লাগলে ত্বরিত জবাব দিবে বলে প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা করেছেন। এরই মধ্যে রাজধানী কিয়েভে সফরে যান ন্যাটোভুক্ত পোল্যান্ড, চেক ও স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীগণ। তারা ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন যারা মানবিক সহায়তা ও শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহূত হবে। অস্ত্র সরবরাহের মধ্যে আরো রয়েছে এম-৭৭৭ হাউত্জার বা হাউইটজার কামান, হামভি সামরিক যান, কামানের গোলা, অজ্ঞাতনামা আকাশচারী অস্ত্র বা ‘ফিনিক্স ঘোস্ট’ ড্রোন যা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এবং এর আগে ব্যবহার করা হয়নি; রাশিয়ার ওপরই প্রথম ব্যবহূত হবে। পশ্চিমা অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ ও কৌশল ব্যবহারের ফলেই ইউক্রেন রাশিয়ার অভিযান ঠেকাতে পেরেছে। নিজেরা যুদ্ধে না জড়িয়ে কৌশলে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার পশ্চিমা এসব ব্যবস্থা রাশিয়াকে উস্কানি দিচ্ছে এবং ক্ষেপিয়ে তুলেছে। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।
যুদ্ধ বন্ধ বা বিরতির জন্য আলাপ-আলোচনা, দ্যুতিগিরি অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত ৪/৫টি আলোচনা হয়েছে দুদেশের মধ্যে। সর্বশেষ মার্চের শেষ দিকে ইস্তাবুলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উদ্যোগে আলোচনা হয়েছে যা ফলপ্রসূ হওয়ার আশা ছিল, কিন্তু হয়নি। তবে উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। আগামী জি/২০ সম্মেলনে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে আহহ্বান জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ইতোমধ্যে গত ২৭-২৮ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রাশিয়া ও ইউক্রেন সফর করেছেন। কিয়েভে গুতেরেসের অবস্থানকালেও রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। মহাসচিব আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিসি) কর্তৃক যুদ্ধপরাধের তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া, যুদ্ধ বিরতির ব্যাপারেও তিনি আলোচনা করেন। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও বারবার যুদ্ধ বিরতির জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। দেশে-দেশে যুদ্ধ বন্ধের জন্য বিক্ষোভও হয়েছে, এমনকি খোদ রাশিয়ায়ও। গত ১ এপ্রিল ২০২২ যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি ও প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। তাতে নোবেল বিজয়ী মার্কিন রাজনৈতিক অধিকারকর্মী জোডি উইলিয়ামস্ এবং ব্রিটিশ চিকিত্সা বিজ্ঞানী রিচার্ড রবার্টস্ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সবাইকে সোচ্চার হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, বিশ্ব জুড়ে স্থল মাইন নিষিদ্ধ করার দাবিতে প্রচারণার অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে জোডি উইলিয়ামস্ এবং ডি এন এ ও জিন গবেষণায় ভূমিকার জন্য ১৯৯৩ সালে রিচার্ড রবার্টস্ নোবেল পান। এই যুদ্ধে জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার জন্য তারা সমালোচনা করেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেনও (অবঃ) এই ওয়োবিনারে বক্তব্য রাখেন। তাদের বক্তব্যে যুদ্ধে রাশিয়ার যেমন দায়িত্ব তেমনি পশ্চিমা ও ন্যাটোর উস্কানিমূলক ভূমিকার কথাও উঠে আসে। মূলত যুদ্ধের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে না। তাই একটা চুক্তিতে উপনীত হতে হবে। রাশিয়া বা পুতিন পরাজিত হবে এই ধারণা বাদ দিয়ে, আবার রাশিয়াও জয়ী হবে তাও বাদ দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা শান্তি চুক্তিতে আসতে হবে যাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকা দূরীভূত হয় এবং বিশ্ব মানবতা রক্ষা হয়। দু’পক্ষকেই কম-বেশি ছাড় দিয়ে সমঝোতায় আসতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে একপক্ষে রাশিয়া একাই বলা চলে। চীন, ভারত এবং আরো কিছু দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়নি, তবে জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থাকলেও কোন সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেনি রাশিয়ার পক্ষে। অন্যদিকে ইউক্রেনের পক্ষে সরাসরি পক্ষ অবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো বাহিনী। এর ফলে ইউক্রেন দখলের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও রাশিয়াকে কৌশলগত পিছু হটতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির দৃঢ়তা এবং অত্যাধুনিক পশ্চিমা অস্ত্র সম্ভার এখন পর্যন্ত রাজধানী ভিত্তিক ইউক্রেন সরকারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রাশিয়াকে একঘরে করার অপূর্ব এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা। তারা ঘোষণা করেছে যে তারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িত হতে চায়না। কিন্তু ইউক্রেনের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক, মিডিয়া, অর্থনৈতিক ও যুদ্ধের চালে চাপে রাখার জন্য সব রকম ব্যবস্থাই নিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। তাই একে পরোক্ষভাবে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শামিল বলা যায়। ইতোমধ্যে এটিকে পশ্চিমা বিশ্বের ‘ছায়া যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিয়েছে বুদ্ধিজীবীরা। উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে রাশিয়াকে দুর্বল ও কাবু করা।
কিন্তু রাশিয়াও কম যায় না। পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেনকে যতই অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ করছে রাশিয়া ততই কৌশল বদলাচ্ছে এবং ক্ষেপনাস্ত্র হামলা বাড়াচ্ছে। একদিকে সরবরাহকৃত অস্ত্রভান্ডার ও ইউক্রেনীয় সামরিক স্থাপণার উপর মিসাইল হামলা করছে রাশিয়া এবং নূতন নূতন শহর দখল করছে। রাশিয়া বুঝেছে যে কিয়েভ দখলে রেখে জেলেনস্কিকে অপসারণ করা সম্ভব নয়। তাই দক্ষিণের ক্রিমিয়া ও দক্ষিণ-পূর্বের দনবাস অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ নেয়া কৌশলগতভাবে বেশী প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে রাশিয়া অগ্রসর হচ্ছে। ওদিকে অবরোধের ধাক্কাও সামলিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। ডলারের বিরূদ্ধে রুবেলের আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা শুরু করেছে রাশিয়া, এমনকি জ্বালানী রপ্তানীতে ইউরোপকে রুবেলে অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করছে। অন্যথায় তাদেরকে জ্বালানী সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। এরই মধ্যে রুবেলে মূল্য দিতে রাজী না হওয়ায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি দক্ষিণের খেরসনসহ অধিকৃত অঞ্চলেও রুবেলের ব্যবহার চালু করেছে রাশিয়া।
সম্প্রতি যুদ্ধ পরিস্থিতি ও কূটনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিস্থিতি যে কোন দিকে মোড় নিতে পারে। জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সম্প্রতি যে জরুরি সম্মেলন হয়েছে তাতে কিভাবে আরো বেশি অস্ত্র দেয়া যায় ইউক্রেনকে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। অধিকন্তু প্রায় একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন কিয়েভ সফর করে কিভাবে এই যুদ্ধে রাশিয়াকে হারানো যায় তার জন্য সবকিছু তারা করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। জার্মানি বলেছে ইউক্রেনকে বিমান বিধ্বংসী ট্যাংক সরবরাহ করবে। এই প্রেক্ষিতে পুতিনের সতর্ক বার্তার পর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভারভ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে ন্যাটো জোট প্রকারান্তরে রাশিয়ার সংগে যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং এটিকে ‘ছায়া যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। যুদ্ধে কে জিতল আর কে হারল সেটির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল বিশ্ববাসী তৃতীয় ও পরমাণু যুদ্ধ চায় না। কেননা তাতে পৃথিবীর চরম ধ্বংস সাধিত হবে। নিজের অবস্থান যদি পশ্চিমা নগ্ন আগ্রাসনে অবমানাকর হয় অর্থাত্ ইউক্রেন অভিযান ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থাকে তবে অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে। সেভাবেই সে কৌশলগতভাবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে যা পরমাণু অস্ত্র বহন করতে পারে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন অবিলম্বে আলোচনার টেবিলে আসে এবং শান্তি চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় সেটাই বিশ্ববাসীর আশা।
লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট