
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি ও সংসদে প্রধানবিরোধী দল জাতীয় পার্টি তত্পর হয়ে ওঠেছে। বসে নেই নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত ছোট বড় অন্য দলগুলোও। মাঠপর্যায়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম বেগবান করে দল গোছানো শুরু হয়েছে এরইমধ্যে। আগামী বছরের শেষার্ধে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনকে ঘিরে কাজ এগুচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনও। যদিও নির্বাচনের রোডম্যাপ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দেড় বছরের মতো সময় হাতে থাকায় একটু ধীরলয়ে কাজ গুছানো হচ্ছে। রোডম্যাপ তৈরির লক্ষ্যে এরইমধ্যে অংশীজনের সাথে সংলাপ শুরু করেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি। সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্বসহ পেশাজীবিদের পাশাপাশি একে একে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার ইচ্ছে রয়েছে কমিশনের। সংলাপে ওঠে আসা মতামতগুলো পর্যালোচনা করে রোডম্যাপ তৈরির কাজে হাত দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইসি সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে রুটিন কাজগুলো সেরে ফেলার দিকে মনোনিবেশ দিয়েছে কমিশন। নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য এই মাসেই ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। ভোটার হালনাগাদের সঙ্গে যুক্ত (তথ্য সংগ্রহকারী, ডাটা এন্ট্রি অফিসার ও সুপারভাইজার) সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণও শুরু হয়ে গেছে এরইমধ্যে। এছাড়া দীর্ঘদিন আটকে থাকা নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ, নাগরিকদের স্মার্টকার্ড প্রদান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করণ, ধারাবাহিক সংলাপের আয়োজন এবং বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলোকে গুছিয়ে এনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কাজ চলছে।
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দায়িত্ব গ্রহণের পর তার নেতৃত্বাধীন ইসির অবস্থান জানিয়েছেন। আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি সবাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করবেন। যারা নির্বাচন করবেন তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কমিশনের। কর্মপদ্ধতি কি হবে সেটি ঠিক করিনি। তবে জানতে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছি। সাংবিধানিক শপথ অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের চেষ্টা থাকবে।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এজন্য ইসির প্রতি সব মহলের আস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সর্বগ্রাহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের রোডম্যাপ তৈরি করতে অংশীজনের মতামত নেয়া হচ্ছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি সর্বসম্মত উপায়ে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে তারা বলেন, নির্বাচন নিয়ে অনেকেই অনেক মত দিচ্ছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংলাপগুলোতে কেউ কেউ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন, অনেকে বিভাগভিত্তিক ভোট অনুষ্ঠান করতে বলেছেন। আরো অনেক মতামত হয়তো পাওয়া যাবে আগামীতে। সব মতামত পর্যালোচনা করে ইসি রোডম্যাপ তৈরি করবে। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ীই নেয়া যাবে চূড়ান্ত প্রস্তুতি। এখন রুটিন কাজগুলো সেরে ফেলা হচ্ছে বলে জানান তারা।
এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে দেড় বছরের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে ইসি। আগামী বছরের শেষ দিকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের টার্গেট রাখা হয়েছে। ইসি সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আগামী মাসের মধ্যে (জুন) সংলাপ শেষ করে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। এরপরে এটি নিয়ে জুলাইয়ের পর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসবে ইসি। এবারের রোডম্যাপে ৭ থেকে ৮টি করণীয় রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক নিবন্ধনের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিচ্ছে ইসি। আগামী ১৫ থেকে ২১ জুন জনশুমারির তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হলে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এক্ষেত্রে ৩০০ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কার্যক্রম আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
এ ছাড়া রোডম্যাপে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কারের বিষয় থাকবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করা; ইভিএমে ভোট গ্রহণ; সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ; ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ; বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোট কেন্দ্র স্থাপন; নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করার কার্যক্রম গ্রহণের নির্ধারিত টাইমফ্রেম থাকবে। জানা গেছে, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ করে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আইন আরপিও ও অন্যান্য আইন এবং বিধিমালা সংশোধন কার্যক্রম শুরু করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আইন সংস্কারের প্রাসঙ্গিক খসড়া প্রস্তুত করা হবে। আগামী বছরের (২০২৩) ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করবে সংশ্লিষ্ট কমিটি। এ ছাড়া আগামী ২০ মে থেকে দেশব্যাপী ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করছে ইসি। এই ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শেষ করে আগামী বছরের ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। সেই ভোটার তালিকা দিয়ে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, সংলাপ শেষে আমরা কর্মপরিকল্পনার একটি খসড়া করব। এরপরে তা নিয়ে আবার আলাপ-আলোচনা হবে। সেটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটা বিশ্লেষণ করব। এরপরেই চূড়ান্ত করা হবে সেই কর্মপরিকল্পনা। আমাদের মেয়াদকালে যেসব কাজ করা সম্ভব আমরা কর্মপরিকল্পনায় সেইগুলোই বেছে নেব। তিনি বলেন, যেগুলো আইন-কানুন সাপোর্ট করে আমরা সেগুলো করব। এরপরে দেখব যদি কোনো আইন-কানুন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তবে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইন-কানুন পরিবর্তনের সেই প্রস্তাবনা দেব।
বিগত নূরুল হুদা কমিশন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়ে ১৬ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের (কর্মপরিকল্পনা) রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল। এরপরে ওই বছরের ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সংলাপের যাত্রা শুরু করেছিল। তবে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন এবার সংলাপের পরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ করার কথা বলছে। ইসি জানিয়েছে, তারা পর্যায়ক্রমে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা, নারী নেত্রী, নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করে রোডম্যাপ প্রস্তুত করবে। এরপরে রোডম্যাপ নিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩ সালের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল। সেই হিসেবে দ্বাদশ নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হবে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর। ভোট শেষ করতে হবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে। ফলে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বরের পর থেকে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে যেকোনো সময় ভোট হতে পারে। আবার সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যেও নির্বাচনের একটি আইনি বিধান আছে। সর্বশেষ দুটি নির্বাচন হয়েছে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে।