• ঢাকা
  • শনিবার:২০২৩:সেপ্টেম্বর || ১৫:৫৩:৫০
প্রকাশের সময় :
মে ১৯, ২০২২,
৯:৩৬ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
মে ১৯, ২০২২,
৯:৩৬ অপরাহ্ন

৩৮৯ বার দেখা হয়েছে ।

ভোজ্যতেল : পকেট কাটার উৎসব বন্ধ হবে কবে?

ভোজ্যতেল : পকেট কাটার উৎসব বন্ধ হবে কবে?

এস এম নাজের হোসাইন

দেশে ভোজ্যতেল নিয়ে তেলেসমাতি দীর্ঘদিনের। গুটিকয়েক আমদানিকারক ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক। শুধু ভোজ্যতেল নয়, সকল ভোগ্যপণ্যসামগ্রী নিয়ে বেশকিছু তথাকথিত মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দেশের বাজার ব্যবস্থাকে বারবার অস্থিতিশীল করছে।

এসমস্ত গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে সাধারণ মানুষসহ সবস্তরের মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এই শোষক শ্রেণির অনৈতিক ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ভার অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

পুরো দেশের মানুষ অনৈতিক, সুবিধাবাদী, মুজতদার, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীদের কাছে বারবার জিম্মি হয়ে পড়েছে। সীমিত আয়ের, হত-দরিদ্র, দিনমজুর, স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, সৎভাবে জীবিকা নির্বাহকারী দেশের মানুষ অসাধু ব্যবসায়ীদের অনৈতিক ও হঠকারী ব্যবসাকাণ্ডের কারণে স্বাভাবিক সংসার চালাতে পারছেন না।

পরিবার-পরিজন নিয়ে দুই বেলা পুষ্টিকর খাবার তাদের কপালে জুটছে না। একদিকে করোনা মহামারিতে অনেকের আয় রোজগার কমেছে, অন্যদিকে সংসার চালাতে অতিরিক্ত খরচের বোঝায় মানুষ দিশেহারা। অবস্থাদৃষ্টে চারদিকে দেশে মানুষের নীরব আহাজারি শোনার কেউ আছে বলে মনে হয় না।

অস্থিরতা ঠেকাতে সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তবে এই সংকটে শুধুমাত্র জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের লোকজন ছাড়া সরকারের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে মাঠে দেখা যায়নি।

রমজানের সময় পনের রোজার পর ঈদের আগে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট, দাম বাড়ানোর পর তেলের প্রচুর সরবরাহ এবং মজুতবিরোধী সরকারের অভিযানের বিষয় কেবল অস্বাভাবিক নয়, অবিশ্বাস্যও বটে।

ভোজ্যতেলের বাজারে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বারবার এদেশের ব্যবসায়ীরা বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। বাস্তবে বিশ্ববাজারের সাথে বাংলাদেশের বাজারদরের কোনো সম্পর্ক নেই।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে তিনি ভুল করেছেন। তার এই সামান্য ভুল যে কত অসামান্য ক্ষতি ডেকে এনেছে, তা মন্ত্রী উপলব্ধি না করতে পারলেও ভোক্তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। অন্যদিকে এই সুযোগে ভোজ্যতেলের খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মিলার-ডিলাররা, খুচরা বিক্রেতারাও পর্যন্ত যে যেভাবে পারে ভোক্তা সাধারণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

৬ ফেব্রুয়ারি ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বৃদ্ধি করেছিল। ওইসময় এ নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ পরিলক্ষিত হয়। সর্বশেষ ৫ মে ২০২২, আবার তেলের দাম বাড়ানো হয় সর্বোচ্চ ৩৮ টাকা এবং পাম তেল ৪৪ টাকা। এক্ষেত্রে তেলের আমদানি এবং পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বাজার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেক পাইকারি ব্যবসায়ী।

ভোজ্যতেলের বাজারে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বারবার এদেশের ব্যবসায়ীরা বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। বাস্তবে বিশ্ববাজারের সাথে বাংলাদেশের বাজারদরের কোনো সম্পর্ক নেই।

ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মধ্যে রান্নার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ভোজ্যতেলের বাড়তি দাম তাদের আর্থিক চাপ আরও বাড়াচ্ছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে কঠোরভাবে বাজার নজরদারি বাড়ানোই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

ঈদের বেশ আগে থেকে আমদানিকারকেরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছিলেন। এর মাত্র কয়েক দিন আগেই তেলের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। রমজানের সময় নতুন করে দাম বাড়ালে জনগণের মধ্য বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে সরকার ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে ঈদের পর দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। এক লাফে সয়াবিনের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়েছেন।

আবার বিপুল পরিমাণ সয়াবিন মজুত করে রেখেছেন। যদিও ঈদের আগে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করলেও তেমন কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। আবার ঐ সময়ে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাপড় ও কসমেটিকসের দোকানে কারসাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সয়াবিন তেলের ওপর দৃষ্টি দিতে পারেনি। আর ব্যবসায়ীরা এই সুযোগই নিয়েছেন এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন।

এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েলের রপ্তানি বন্ধ করে দেয় এবং আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল রপ্তানি কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশ মূলত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে। ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনার ঘোষণা ব্যবসায়ীদের বাড়তি সুবিধা এনে দেয়।

বাণিজ্যমন্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি, তিনি ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ভুল করেছেন। তারা কথা রাখেননি। কিন্তু তিনি কীভাবে ভাবলেন তারা কথা রাখবেন? ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন মুনাফার জন্য। মন্ত্রীর হিতোপদেশ বা সতর্কবাণীতে যে কোনো কাজ হয় না, তা ফের প্রমাণিত হলো।
মিল মালিকেরা সরবরাহ কমিয়ে দেন, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আরও বেশি লাভের আশায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তেল মজুত করেন। ফলে ঈদের দুই দিন আগে বাজার থেকে তেল উধাও হয়ে যায়। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিপুল পরিমাণ সয়াবিন ও পাম অয়েলবাহী জাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছেছে। সেসব জাহাজ এখন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করছে।

আবার গত বছর দেশের উদ্যোক্তাদের আমদানি করা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সয়াবিন ও পাম অয়েলের শুল্কায়ন করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলেও দেশে এখন সংকটের কারণে তেলের দাম বাড়ার কথা নয়।

তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এসবের কারণে মূল্যবৃদ্ধির বিষয় সত্য হলেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব অন্তত আরও দুই মাস পর পড়বে। ফলে এ অজুহাতেও দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। সুতরাং কৃত্রিমভাবে যে সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কয়েক দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে সরকারি সংস্থা ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তাদের অভিযানে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি না থাকলেও ডিলারদের কারসাজিতে বাজারে সয়াবিন তেলের ‘কৃত্রিম সংকট’ সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। অভিযানে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে জরিমানা করা হচ্ছে।

তবে বাণিজ্যমন্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি, তিনি ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ভুল করেছেন। তারা কথা রাখেননি। কিন্তু তিনি কীভাবে ভাবলেন তারা কথা রাখবেন? ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন মুনাফার জন্য। মন্ত্রীর হিতোপদেশ বা সতর্কবাণীতে যে কোনো কাজ হয় না, তা ফের প্রমাণিত হলো।

যদি ঈদের আগে সরকার বাজার তদারকি ও নজরদারি বাড়াত, তাহলে ব্যবসায়ীরা মজুতদারির সুযোগ পেতেন না। এখানে ক্ষুদ্র দোকানদার, মৌসুমি ব্যবসায়ী, ডিও দালাল, পাইকারি বিক্রেতা, রিফাইফানারসহ বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসায়ীরা বারবার সরকারকে হুমকি প্রদান করছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে তদারকি অভিযান পরিচালিত করা হলে তারা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। এই হুমকিতে তদারকি অভিযান শিথিল করা হলে এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি নিত্যপণ্যের অন্যান্য পণেও সম্প্রসারিত হবে। যা ইতিমধ্যেই পেঁয়াজে সংক্রমিত হয়েছে।

সরবরাহ ঘাটতিজনিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। এ ধরনের সংকটে দাম কম-বেশি সবখানেই বাড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দামের সমন্বয় এমনভাবে করা হয়, যাতে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর অভিঘাত যথাসম্ভব কম পড়ে। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোথাও বাজার বিকৃতি ঘটছে কি না, বিপণন ব্যবস্থায় সমস্যা হচ্ছে কি না, ক্ষুদ্র কোনো গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করছে কি না সবকিছু অনুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা হয়।

আইন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রকৃত কারণে দাম বাড়লে সরকারি উদ্যোগে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যাতে সর্বসাধারণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিবেশী ভারতেও মানুষের ওপর দাম অভিঘাত প্রশমনে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। ওইসব দেশের নীতি ও অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *