• ঢাকা
  • শুক্রবার:২০২৩:ডিসেম্বর || ২০:৩১:০৮
প্রকাশের সময় :
এপ্রিল ১৪, ২০২২,
১০:৩১ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট :
মে ১৩, ২০২২,
১০:৩২ অপরাহ্ন

৪২৩ বার দেখা হয়েছে ।

স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে

স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে ১৯৪৮ সালে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনুভব করেছিলেন সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশভাগ তাদের জীবনধারণের মধ্যে তেমন জোরালো কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। বাঙালি মুসলমান শ্রেণি যতটুকু না সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে ভারতবর্ষ বিভক্তিতে সমর্থন জানিয়েছিলেন তার চেয়েও অধিক আগ্রহটা ছিল ভারতবর্ষে তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনাটি। ফলে, তারা অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু হিসেবে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির অংশীদার হয়ে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাদের সেই বিভোর ভাবনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম আঘাতটি করেন ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মধ্য দিয়ে।

একথা এখানে বলা আবশ্যক যে, জিন্নাহ পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের কাছে তখন ছিলেন নমস্য ব্যক্তি। মুসলমান সমাজে জিন্নাহ অবিসংবাদিত হয়েছিলেন ভারতবর্ষ থেকে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির জন্ম দিয়ে। মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় অনুন্নত ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় এবং চাকরিসহ আর্থিক নিরাপত্তার সব স্তরে। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে বানানোর বিষয়ে এই অঞ্চলের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মুসলমান বা তাদের অংশীদার নেতাকর্মীদের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। প্রতিক্রিয়া যা হয়েছিল ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে। এই ছাত্র-শিক্ষকদের সমাজকে সাধারণ মানুষের কাছে এমন কি এলিট শ্রেণির ধনী মুসলমানদেরও বোঝাতে হয়েছে তাদের দাবি উর্দু ভাষাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে নয়; বরং নিজ জনপদে নিজের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তারা লড়াই করছেন। যেহেতু বাংলা ভাষা এই অঞ্চলের মানুষের মৌলিক ভাষা, সুতরাং বাংলা ভাষা হবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের রাষ্ট্রভাষা। ছাত্রদের এই দাবিকে একসময় ঢাকার নিয়ন্ত্রক বলে চিহ্নিত সর্দাররাও মেনে নেন এবং তারা ছাত্রদের সমর্থনও দান করেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষার অধিকার।

জাতিগতভাবে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের বিষয়গুলো ক্রমে আরও বলবান হতে থাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির শাসকদের বৈষম্য, বঞ্চনা ও আগ্রাসন থেকেই। বাঙালিদের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তানের শোষক-শাসকশ্রেণির আগ্রাসী কর্মকাণ্ড। পাকিস্তানি সরকার ব্যবস্থায় সামরিক জান্তাদের ক্রমাগত ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া ও শাসনতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ এদেশের মানুষকে স্বভাবতই এ সত্যটি অনুভব করতে সাহায্য করেছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার কোনোদিন বাঙালিদের আলাদা করে কিছু দিবে না। তারা বাঙালিদের বঞ্চিত করবে তাদের নায্য অধিকার থেকে এবং এদেশের সম্পদ থেকে উপার্জন করে কেন্দ্রে নিয়ে যাবে। কিন্তু এসব কথা বলবার জন্য এককভাবে ছাত্র সমাজ যথেষ্ট নয়। বাঙালিদের দাবিগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের সম্মিলিত আন্দোলন। আর এমন প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ’র পথে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এক উদীয়মান নেতা। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে ওঠে আসা সেই উদীয়মান সূর্যের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে তিনি বৈষম্য ও নিপীড়ক শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে তাঁর জীবনের প্রধানতম কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছিলেন।

শতবার বাঁধা এসেছিল, ঝড়-ঝঞ্ঝা এসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। শাসকদের রক্তচক্ষুর রোষানলে কারাগার তাঁর বাসস্থান হয়েছিল, জুলুম করে অধিকার খর্ব করেছিল পাকিস্তানি শোষকের দল। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। তাঁর তেজস্বী নেতৃত্ব, বজ্রকণ্ঠের হুঙ্কার আর গণমানুষের মুক্তির জন্য তাঁর অদম্য আগ্রহ গ্রাম থেকে শহুরে মানুষের কাছে প্রেরণাময় বাণীর মতো হয়ে ওঠেছিল। দেশবাসী ও নগরবাসী বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানকে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে মনে করেছিলেন। জাতীয়তাবোধের ধারণাটিকে বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে মেলে ধরার যে কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন এমন শক্ত অবস্থানে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে বাংলার মানুষের দুর্দশার কথা বলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মানুষ তাদের ‘জীবনবন্ধু’ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। বরণ করেছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির একমাত্র দিশারী হিসেবে।

বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ডের জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিগত সময়গুলোতে সরকারিভাবে যে অপপ্রচার করা হয়েছিল, পাঠ্যপুস্তকসহ জাতির সব স্তরে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ইতিহাস বিকৃতির যে উদ্যোগ তৎকালীন সরকারেরা নিয়েছিলেন- এর পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। তরুণ সমাজ সত্য ইতিহাসকে জানতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু চারিদিকে বিভ্রান্ত নাগ-নাগিনীর ছোবল আমাদের তরুণদের পথভ্রষ্ট করে রেখেছিল সত্য জানার তীব্র বাসনা থাকা সত্ত্বেও।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার কোনো সুযোগ ছিল না। এ সত্যটি তারা জানত বলেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়ানক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে ইতিহাসের বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেই এই খুনি চক্র বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তান বানানোর মতলব করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সব কার্যক্রমকে প্রণোদনা দানে তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা বাঙালি জাতিসত্তাকে ম্লান করে দিয়েছিল।

যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তারা দেশের মানচিত্রকে কলঙ্কিত করেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে তারা মূলত: গোপনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার মিশন বাস্তবায়ন করে গেছে। ফলে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে বাংলার মাটি।

যে দুঃখবোধের দহন থেকে লেখাটির জন্ম তার সূচনা নিহিত হয়েছে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের ভেতর একটি দাবিকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করে। স্বাধীনতার জন্য ২৪ বছরের সংগ্রামের নিপুণ কারিগর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশকে নির্মাণে সবচেয়ে বড় বাধা সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান। তাদের গোপন কার্যক্রমকে যেকোনো মূল্যে দমন করতে হবে। জামাতসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূমিতে অশুভদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে না। আমাদের মনে রাখা উচিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা শুধু ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। একটি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের মর্মস্পর্শী আত্মহুতি হাজারও স্মৃতি আমাদের সব আনন্দের মধ্যে একটি অপূর্ণ বেদনার সাক্ষী বহন করছে। তাঁদের সেই রক্তঋণে সজ্জিত আমাদের জাতীয় নিশানা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে ত্যাগের মহিমার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তাঁর কন্যা জীবনের ভয়কে তুচ্ছ করে তা বাস্তবায়নে সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। বিরামহীন মহাযাত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য স্থির হয়ে আছে বাংলাকে সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার বাসনায়। উন্নয়নের এই নবজাগরণ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে সীমাহীন উচ্চতায় আসীন করবে এ বিশ্বাস আমাদের আছে। শুধু রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রয়োজন যোগ্য, মেধাবী, সৎ, মননশীল, রুচিবান, স্বাপ্নিক, সাহসী কতিপয় নেতাদের। তারাই বাংলাদেশের মূলমন্ত্রকে অনুস্মরণ করবেন।

লেখক- সাংবাদিক, গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মী।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *